Connect with us

মতামত

গ্ৰন্থাগার’শব্দটির অপপ্রয়োগ ও একজন গ্ৰন্থাগারিকের প্রতিবাদ

Published

on

আমাদের দেশের অধিকাংশ পুস্তক বিক্রেতা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘ গ্ৰন্থাগার বা লাইব্রেরি” শব্দটির অপব্যবহার নতুন কোন বিষয় নয়। ঠিক কবে থেকে,কার মাধ্যমে পুস্তকের দোকানের নামের শেষাংশে গ্ৰন্থাগার শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে তা আজ বড়ই অদ্ভুত রহস্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি কিংবা প্রথিতযশা মনীষীদের গ্রন্থাগার শব্দটির উপযুক্ত ব্যবস্থার নিয়ে তেমন উচ্চ বাচ্য করতে দেখিনি। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্ৰন্থাগার পেশাজীবীগন পুস্তক বিক্রেতাদের খামখেয়ালিপনা ও বুক স্টলগুলোকে লাইব্রেরি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার উদ্ভট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা মৌখিক প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন না।

অবস্থা এমন হয়েছে যে কোনটা প্রকৃত গ্ৰন্থাগার আর কোনটা বইয়ের দোকান তার পার্থক্য করাটাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পুস্তকের দোকান আর গ্রন্থাগারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে সংজ্ঞাতাত্বিক বিস্তর পার্থক্য। বুক স্টোরগুলোর মুল উদ্দেশ্য মূলতঃ পাঠ্য পুস্তক কেনা বেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ গ্ৰন্থাগার কিংবা লাইব্রেরি পাঠ্য পুস্তক বিনামূল্যে পাঠকদের জন্য সংগ্ৰহ , সংরক্ষণ ও বিতরণের উদ্দেশ্য গড়ে উঠে এবং আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

সারাদেশে  পুস্তক ব্যবসায়ীরা অজ্ঞতার কারণেই হোক কিংবা ইচ্ছে করেই লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ করে চলেছেন যা গুটিকয়েক ব্যক্তির পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাঁরা বুক স্টোরগুলোর লাইব্রেরি নাম ধারণ করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর।

জনাব মোঃ মামদুদুর রহমান এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্ৰন্থাগার পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্ৰন্থাগারিক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৯ সালে তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।  বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সেন্টারের উপ পরিচালক হিসেবে কর্মরত ও বাংলাদেশ গ্ৰন্থাগার পেশাজীবী সমিতির সদস্য।বাংলাদেশে যেকজন ব্যক্তি  বুক স্টোরগুলোর নামের শেষাংশে লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ নিয়ে বেশ সোচ্চার তিনি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরে’র সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সেন্টারের উপ পরিচালক জনাব মোঃ আব্দুস সামাদ প্রধান ও অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে তিনি রংপুর শহরের বিভিন্ন বুক ইস্টারগুলোকে লাইব্রেরি শব্দটিকে অপপ্রয়োগ না করতে বারংবার অনুরোধ জানান। তিনি রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষন পূর্বক রংপুর শহরের ট্রেড লাইসেন্স কর্মকর্তা/ সচিব বরাবর লিগাল নোটিশ পর্যন্ত পাঠিয়েছেন যাতে করে পুস্তক ব্যবসায়ী কতৃক লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ বন্ধ করা যায়।  তার ভাষায় লাইব্রেরি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠকদের জন্য সকল ধরনের বই-পুস্তক , গবেষণা সামগ্ৰী, ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লাইব্রেরি ব্যবহারকরীদের সরবারহ করা হবে ,তা কোনক্রমেই ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য নয়। যেনটা Oxford English Dictionary থেকে জানা যায়, “ Library is a building in which collection of books, newspapers, etc., and sometimes films and recorded music are kept for people to study or borrow” অর্থাৎ, লাইব্রেরি বা গ্ৰন্থাগার হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা পুস্তক, সংবাদপত্রের সমাহার, এছাড়াও চলচ্চিত্র ও রেকর্ড করা সংগীত জনসাধারণের পড়া ও ধার প্রদান করার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়।

এখানে লাইব্রেরির জ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে সভ্যতার বিকাশ সাধনকারীর ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে পুস্তক বিক্রেতা গন যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। উইকিপিডিয়া প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী “ A library is a curated collection of sources of information and similar resources, selected by experts and made available to a defined community for reference or borrowing, often in a quiet environment conductive to study”, অর্থাৎ লাইব্রেরি হলো বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা  সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত তথ্য ও তথ্য সদৃশ পঠন সামগ্রীর সমাহার যা সুনির্দিষ্ট ব্যবহারকরীদের নির্মল ও শিক্ষা সহায়ক পরিবেশে জ্ঞান নির্দেশনাসরূপ অথবা ধার কার্যের জন্য পঠন সামগ্রী প্রদান করে থাকে। ইউনেস্কো প্রদত্ত সংজ্ঞায় গ্ৰন্থাগার বা লাইব্রেরি হলো ,” মুদ্রিত বই , সাময়িকী অথবা যেকোন চিত্রসম্ভার বা শ্রবণ, দর্শন সামগ্ৰীর একটি সংগঠিত সংগ্ৰহ। যেখানে পাঠকদের তথ্য-প্রযুক্তি, গবেষণা, শিক্ষা অথবা বিনোদন চাহিদা মেটানোর কাজে সহায়তা করা হয়।

গ্ৰন্থাগার যেখানে পাঠকদের সেবার মান নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,বুক স্টোরগুলো সেখানে পুস্তক ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করতে বদ্ধপরিকর। জনাব মামদুদুর রহমানের আক্ষেপের জায়গাটা এখানে। একজন গ্ৰন্থাগার পেশাজীবী হিসেবে পুস্তক ব্যবসায়ীদের লাইব্রেরির নামে বই কেনাবেচার সংস্কৃতি কোনদিনও মানতে পারেননি। তিনি ২০১৫ সাল থেকে পুস্তক ব্যবসায়ীদের বুক স্টোরগুলোতে”লাইব্রেরি” শব্দটির অপপ্রয়োগ নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার,‌ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আর,এস ও ৭ নং আইন/২০১৭, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯(২০০৯ সালের ৫৮নং আইন) এর ধারা ১০০ তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার আদর্শ কর তফসিলের ৬ এর উপদফা (১) এর পরিবর্তে ৪২ এর (৭) ও (৮) উপটেবিলের ধারা অনুযায়ী পুস্তক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নাম: পুস্তক বিক্রেতা বা পুস্তক প্রকাশকের নামে নামকরণ হবে। সে অর্থে কোন পুস্তক বিক্রেতা ‘ লাইব্রেরি’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন না।  

জাতির মেধা ও মননশীলতার প্রতীক হিসেবে গ্রন্থাগার সুপ্রাচীন কাল থেকেই পাদপ্রদীপের ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে গ্ৰন্থাগারের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গ্ৰন্থাগার সুশিক্ষিত ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে লাইব্রেরির নিয়ে পুস্তক ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতা ও খামখেয়ালিপনার অবসান ঘটানো সময়ের দাবি। জনাব মোঃ মামদুদুর রহমানের মতো কিছু আলোকিত মানুষের প্রচেষ্টা ও আন্দোলনের মাধ্যমে একদিন নিশ্চিতভাবেই বইয়ের দোকানের নামের শেষাংশে লাইব্রেরি শব্দটির অপব্যবহার লোপ পাবে এবং লাইব্রেরি ও লাইব্রেরি পেশাজীবীদের মানবিক মর্যাদা আরো সুসংহত হবে। লাইব্রেরিগুলো সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠবে জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চার প্রানকেন্দ্র।

আকতারুল ইসলাম
লেখক ও গবেষক
[email protected]

Continue Reading

আন্তর্জাতিক

সাম্রাজ্যবাদের বিষবাষ্প ও ফিরে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

Published

on

By

মানব সভ্যতার অগ্ৰযাত্রা কখনোই বাঁধা মুক্ত, অবিরাম চলমান কিংবা চির মসৃণ ছিল না। সভ্যতার বিকাশে কতগুলো নিয়ামক শক্তি বিদ্যমান যেগুলো সভ্যতার গতি প্রাবাহকে টেনে ধরেছে প্রতিনিয়ত, থামিয়ে দিতে চেয়েছে এর বিকাশ ও উন্মেষকে । প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী নিয়ামকসমূহের মধ্যে যেমন রয়েছে কিছু প্রাকৃতিক কার্যকারণ , তেমনই রয়েছে কিছু মানবসৃষ্ট প্রভাবক যা সভ্যতার বিনির্মাণের পথে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। মানবসৃষ্ট যেসকল প্রভাবক সভ্যতার অগ্ৰযাত্রাকে বারবার রুদ্ধ করেছে,তাদের মধ্যে যুদ্ধ অন্যতম অনুঘটক। মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যেসকল যুদ্ধ ইতিহাসের পট পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভয়াবহ ও আলোচিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের চেতনা লালনকারী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অক্ষ শক্তির প্রতিনিধি জার্মান, জাপান ও ইতালির মতো দেশগুলোর সাথে তথাকথিত উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী মিত্র শক্তির প্রতিনিধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও দুঃখজনক ঘটনা। জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও জার্মান শ্রেষ্ঠত্ববাদ তত্ত্বের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়। ক্ষমতা লাভের পরপরই তিনি  জার্মানিকে অস্ট্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৯৩৬ সালের দিকে জাপান ও জার্মানির মধ্যে কমিনটার্ন বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৩৭ সালে মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালি ওই চুক্তিতে যোগদান করলে দেশ তিনটির‌ মধ্যে বার্লিন-রোম- টোকিও অক্ষচুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিটি ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া বিরোধী চুক্তি। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত হিটলার জার্মানিকে অস্ত্রে সুসজ্জিত করেন এবং ইউরোপের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী নাৎসি বাহিনী গঠন করেন। চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার চেকোস্লাভাকিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যার ফলশ্রুতিতে চেকোস্লাভাকিয়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে মোমেল বন্দর জোরপূর্বক দখল করে নেন। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে ডানজিগ বন্দর দখল করে নেন এবং এরফলেই আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ও পরাজিত পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া বৈষম্যমূলক বিভিন্ন চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক শক্তির বিষবাস্প ও সম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধংদেহী মনোভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সহায়ক পরিবেশে সৃষ্টি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তির অন্যতম প্রতিনিধি জার্মানির জন্য চাপিয়ে দেয়া ভার্সাই চুক্তি ছিল চরম অপমানজনক। এই চুক্তির ফলে জার্মান  সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে  ভেঙ্গে পড়ে। সাম্রাজ্যের অন্তর্গত দেশসমূহ হাতছাড়া হয়ে যায়। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে জার্মানির ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয় যা দেশটির মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহার সঞ্চার ঘটে এবং পরবর্তী যুদ্ধ ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চলমান ঘটনাবহুল এই মহাযুদ্ধ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানি ঘটিয়ে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্য প্রতিফল। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র, শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যপক অবনমন ঘটে। ভার্সাই চুক্তি গণতন্ত্রের পরিবেশকে দুর্বল করে দেয় এবং সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে গণতন্ত্র, শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের আন্দোলন ত্বরান্বিত হয় যা আরেকটি যুদ্ধের পথকে প্রশমিত করে। গ্ৰেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর মনোভাব জার্মানিকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে। জাপান ও ইতালির মতো পরাশক্তিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের জন্য বিশ্বব্যপী প্রাধান্য বিস্তার করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপত্তি অর্জন করা একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়। এরফলে জাপান, জার্মানি ও ইতালির মাঝে মৈত্রী তৈরি হয় এবং যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠে।এসময় সারাবিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে দেশে নৈরাজ্যবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।  অথচ এই নিরাজ্যবাদ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে মোকাবেলা করতে লীগ অব নেশন ও ব্রিটেন- ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশগুলো সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। সাম্রাজ্যবাদী জাপান কর্তৃক ১৯৩১ সালে মানচুরিয়া দখল, ১৯৩৭ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালি কতৃক ইথিওপিয়া দখল ও স্পেনের গৃহবিবাদ তৎকালীন পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে।১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে দেশটিতে উগ্ৰজাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে যার বিষবাষ্প পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের স্বৈরাচারী মনোভাব বা সর্বাত্মকবাদ (Totalitarianism) গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কামনায় সম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয় যার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি এবং এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ক্ষতির চেয়ে পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বিশ্ববাসী এই যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পত্যক্ষ করেছিল পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা যার প্রভাব এখনো জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে  বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের কারণে সমাজতন্ত্র বিকাশ লাভ করে এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পূঁজিবাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়। পশ্চিম জার্মানিতে ও পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা পূঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র- এই দুই প্রধান ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে যা তৎকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করে। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদী রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্জন যা আদ্যবধি টিকে আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা মানব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অনেক দেশের হাতেই আনুবিক অস্রের মজুদ রয়েছে এবং অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিশ্বব্যপী অস্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র পরিসরে যুদ্ধ চলমান থাকলেও তা কখনোই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ লাভ করেনি। জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী সংগঠন বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে পৃথিবীকে যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব জাগ্ৰত হওয়া আশু প্রয়োজন। রাজনৈতিক মহলে শুভবুদ্ধির উদয় হলেই মানব সভ্যতা যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবী হয়ে উঠবে সবার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

লেখক- আকতারুল ইসলাম

তথ্যসূত্র- তারেক শামসুর রেহমান, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর,ঢাকা,২০১৯.

Continue Reading

বিনোদন

যে কারণে একাধিক নারিতে আসক্ত হয় পুরুষেরা

Published

on

By

একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, পুরুষ বা নারী প্রত্যেকেই জীবনে একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গিনী পেতে চান। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এটা সম্পূর্ণ ভুল। কখনই পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সঙ্গী বা সঙ্গিনী পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা একই রকমের হয় না। বরং নারীদের চেয়ে অনেক বেশি এই আকাঙ্ক্ষা বা আসক্তি থাকে পুরুষদের মধ্যে। যৌবনকালই হোক বা মধ্যবয়স অথবা বার্ধক্য একাধিক সঙ্গিনীর সান্নিধ্য পেতে চান সব পুরুষই৷ কিন্তু কেন, জানেন?

সম্প্রতি ১৫ হাজার পুরুষ ও নারীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান গবেষকরা৷ সেই সমীক্ষা থেকেই তারা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন৷ জানা গেছে, সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা পুরুষ ও নারীদের আলাদা আলাদাভাবে প্রশ্ন করা হয় তাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর বিষয়ে৷ জানতে চাওয়া হয়, এখনও পর্যন্ত কতজন পুরুষ বা নারী তাদের জীবনে এসেছে? বা কতজনের সঙ্গে এখন পর্যন্ত যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছেন তারা? যা উত্তর এসেছে তাতে কার্যত অবাক গবেষকরা৷

জানা গেছে, উত্তরে নারীদের তুলনায় অনেক বেশি সঙ্গিনীর কথা উল্লেখ করেছেন পুরুষরা৷ ১৬ থেকে ৭৪ বছর বয়সের মধ্যে পুরুষরা জানিয়েছেন, এই সময়কালের মধ্যে তাদের জীবনে গড়ে ১৪ জন করে নারী এসেছে৷ কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কারও সঙ্গে হয়েছে কেবল মিষ্টি প্রেম সম্পর্ক৷ অপরপক্ষে একই প্রশ্নের উত্তরে, একই বয়সের নারীরা জানিয়েছেন, গড়ে সাতজন করে পুরুষের সঙ্গে প্রেম করেছেন বা যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ অর্থাৎ এটা প্রমাণিত হয়েছে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের প্রেমে পড়ার বা যৌন আসক্তি অনেক বেশি৷

উত্তরের এই ট্রেন্ডের পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলে জানান গবেষকরা৷ তাদের মতে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের মধ্যে যৌন আসক্তি বাড়তে থাকে। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবল একাধিক নারীর সান্নিধ্যই পেতে চান তারা৷ তাদের মনে বাড়তে থাকে সঙ্গমের ইচ্ছা৷ যা আরও বেশি করে পুরুষদের মধ্যে সঙ্গিনী খোঁজার তাড়না বাড়ায়৷

সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন

Continue Reading

Trending

%d bloggers like this: